কেন ইউক্রেনে সামরিক হামলা, কী চান পুতিন?

অনলাইন ডেস্ক •

প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করেছে রাশিয়া। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে এই সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে। অভিযান শুরুর পর ইউক্রেনে ব্যাপক প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। শুধু বৃহস্পতিবারই ১৩৭ জন সামরিক-বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইউক্রেনের সেনা অস্ত্র পরিত্যাগ করলেই আলোচনা হতে পারে।

গত বছরের শেষ দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ দাবি করে আসছিল যে, ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে পারে রাশিয়া। এ লক্ষ্যে ইউক্রেন সীমান্েতর কাছে বড় ধরনের সেনা সমাবেশ করছে দেশটি। পাশাপাশি বড় ধরনের যুদ্ধের মহড়া চালাচ্ছে। যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে বারবার তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ রাশিয়াকে বারবার সতর্ক করতে থাকে যে, ইউক্রেনে অভিযান চালালে রাশিয়াকে কঠোরতর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে হবে।

পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার হুমকি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান শুরু করেছে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠছে কেন রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করল? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক খবরে বলা হয়েছে, ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম মূলভিত্তি ছিল ইউক্রেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটো পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কমিউনিস্ট বলয়ে ছিল এমন কয়েকটি দেশকে সদস্য করে নেয়। ইউক্রেন ভবিষ্যতে সদস্য হবে বলেও জানায় ন্যাটো। পুতিন ন্যাটোর এই সম্প্রসারণকে সব সময় অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখেছেন। রাশিয়া বরাবরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের বিরোধিতা করে এসেছে। একই সঙ্গে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ইউক্রেনের রয়েছে তার বিরোধিতা করেছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাশিয়া এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা চায় যে, ইউক্রেন কখনো ন্যাটোর সদস্য হবে না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুতিন জানতেন পশ্চিমারা এই দাবি মানবে না। এর মাধ্যমে পুতিন ইউক্রেনে হামলার এক ধরনের যুক্তি খুঁজে বের করেছেন। এ নিয়ে পুতিন দীর্ঘ আলোচনায় যেতেও রাজি নন। তার মতে, পশ্চিমারা নিশ্চয়তা দিলে এখনই দিতে হবে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করিনি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছে। রাশিয়ার স্বার্থ আর নিরাপত্তা নিয়ে কোনো দর-কষাকষি হবে না। একই সঙ্গে পুতিন চান, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বুলগেরিয়ার মতো রাশিয়ার সম্মুখের দেশগুলো থেকে ন্যাটোকে পিছু হটতে হবে।

ইউক্রেনের বর্তমান সরকার গত কয়েক বছরে পশ্চিমাদের দিকে ঝুঁকছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ্যে বলেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। যদিও ইউক্রেনের শিগগিরই ইইউ বা ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা ছিল না।

এ অবস্থায় ইউক্রেনে হামলার রাস্তা খুঁজছিলেন পুতিন। যে রাস্তা আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশপন্থি সরকার উৎখাতের পর রাশিয়া অভিযান চালিয়ে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। সে সময় রুশপন্থি বিদ্রোহীরা পূর্ব ইউক্রেনের দোনেত্স্ক ও লুহানস্ক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তখন থেকে ইউক্রেনের সেনাদের সঙ্গে লড়াই চলছে বিদ্রোহীদের। এই দুটি এলাকায় ‘প্রক্সি’যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল দুই দেশ। যদিও রাশিয়া বিদ্রোহীদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। গত প্রায় আট বছরে এই দুটি অঞ্চলে সংঘাতে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

দোনেত্স্ক গণপ্রজাতন্ত্র বা ডিএনআর-এর রুশ সমর্থিত নেতা ডেনিস পুশিলিন এবং লুহানস্ক প্রজাতন্ত্র এলএনআর-এর রুশ সমর্থিত নেতা লিওনিড পাসেচনিক ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের বিজয়কে স্বীকৃতি দেয়নি। এই দুই নেতাই তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা দুটি রুশ ফেডারেশনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। গত সপ্তাহে এই দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এলাকাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর পুতিন দোনেত্স্ক ও লুহানস্কে ‘শান্তিরক্ষা মিশনের’ জন্য রুশ সেনা পাঠিয়েছেন। এর অর্থ হলো রুশ সৈন্য এখন সার্বভৌম ইউক্রেন রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে মোতায়েন হবে।

এই যুদ্ধের মাধ্যমে কী চাইছেন পুতিন? সিএনবিসি বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার লড়াই। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই অভিযান প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর জন্য রাশিয়ার একটি সতর্ক বার্তা। গার্ডিয়ান বলেছে, এক্ষেত্রে অনেকগুলো তত্ত্ব রয়েছে। পুতিন অনেক বারই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্য দুঃখের কথা জানিয়েছেন। এখন পূর্ব ইউরোপে পুতিন রাশিয়ার প্রভাববলয় তৈরি করতে চান। এছাড়া এ হামলার মাধ্যমে পুতিন পশ্চিমাদের কাছে জানান দিতে চান যে, রাশিয়া এখনো বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার উদ্দেশ্য আরো বেশ কিছু। পুতিন আসলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আবারও প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

সর্বাত্মক সামরিক হামলার দ্বিতীয় দিনেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ঢুকে পড়েছে রুশ সেনারা। এই অভিযানের চূড়ান্ত লক্ষ্য এখনো অজানা। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত করেই পুতিন ক্ষান্ত দেবেন কি না, তার উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন।